Monday, November 13, 2006

হতভাগা দেশ ও আব্দুল আজিজের কিসসা

আব্দুল আজিজ বাদশার ছেলে তাহার ভারী অহংকার। অহংকার হইবে নাই বা কেন? তিনি কত বড় বিদ্বান মানুষ। তাহার বাবা কত সাধনা করিয়া তাহাকে লেখাপড়া শিখাইয়াছেন। স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িবার সময় কত টাকা খরচ করিয়া তাহাকে এত্ত বড় বড় বই কিনিয়া দিয়াছেন, জামা কিনিয়া দিয়াছেন, জুতা কিনিয়া দিয়াছেন। কত্ত বড় বড় বই পাঠ করিয়া তিনি জজ বেরিষ্টার হইয়াছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হইয়াছেন। এই দেশের মুর্খ মানুষেরা এইসবের মর্ম কিছুই বুঝে না। বুঝিবেই বা কেমন করিয়া তাহাদের বুদ্ধির দৌড় কী আর অতদুর আছে?
চেয়ারে একবার বসিলে সেই চেয়ারের প্রতি যে কী অসাধারন ভালোবাসা জন্মে মুর্খ জনগন তাহার কী বুঝিবে? তাহারা হুদাহুদি মিছিল করে, মিটিং করে, গলা ফাটাইয়া শ্লোগান দেয় আর আমাদের এত বড় গুনি একজন মানুষ আব্দুল আজিজকে গদি হইতে নামানোর জন্য খামোকা টানাটানি করে। তাহারা বুঝে না তিনি বাংলাদেশের সংবিধান কর্তৃক প্রেরিত পয়গম্বর। তাহাকে গদি হইতে নামাইতে হইলে পবিত্র গ্রন্থে পরিবর্তন আনিতে হইবে, যাহা মানবের দ্বারা সম্ভব নয়। তাহারা ইহাও বুঝে না যে, যে দেশে গুনির কদর নাই সেদেশে গুনি জন্মে না। বুঝিলে কী আর কাজ কর্ম বাদ দিয়া একজন গুনি মানুষের গদি নিয়া টানাটানি করিত?
হতভাগ্য জনগন ইহাও বুঝে না যে, বাদশার ছেলে আব্দুল আজিজ কত বড় ক্ষমতাধর! তিনি একা একদিকে থাকিয়া গোটা দেশের বারোটা বাজাইয়া ছাড়িতেছেন। রাস্তাঘাট ব্যবসা বানিজ্য অফিস আদালত সকল কিছু বন্ধ হইয়া যাইতেছে তাহার ক্ষমতার দাপটে। একজন মানুষের ক্ষমতায় একটি দেশ অচল হইয়া যাইতেছে আর আমাদের হতভাগা দেশের মুর্খ মানুষেরা এমন ক্ষমতাধর একজন মানুষের গদি লইয়া বেহুদা টানাটানি করিতেছে।
সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দন্ডমুন্ডের কর্তা তিনি, তিনি আমাদের গুরুজন। অথচ মুর্খ দেশবাসী ভুলিয়াই গিয়াছে, "আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে, আমি যেন সেই কাজ করি ভালো মনে।"

Tuesday, November 07, 2006

গরুর গাড়ীতে চড়েছে উত্তরের সংস্কৃতি -১

"ও কি গাড়ীয়াল ভাই, হাকাও গাড়ী তুই................" এই ভাওয়াইয়া গানটি শোনেন নি এমন বাংলাদেশী খুজে পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য হলেও নির্মম বাস্তবতা হলো উত্তরাঞ্চল থেকে এই গরুর গাড়ী আর 'ভাওয়াইয়া গান' দুটোই হারিয়ে যেতে বসেছে।
ভাওয়াইয়া গান হল উত্তরাঞ্চলের নিজের গান, মাটির গন্ধ থেকে উঠে আসা প্রানের গান। দু'একজন শিক্ষিত গীতিকার কিছু গান রচনা করলেও অধিকাংশ গানই রচিত হয়েছে নিতান্তই স্বল্প শিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত মানুষের দ্বারা। একজন অশিক্ষিত মানুষ আর যাই পারুক, কৃত্রিমতার আশ্রয় নিতে পারে না, ফলে এই ভাওয়াইয়া গানগুলোতে সাধারন মানুষের অকৃত্রিম আবেগ, কৃত্রিমতা বিবর্জিত অনুভুতির সরল বহি:প্রকাশ ভাওয়াইয়া গানকে দিয়েছে পুরোপুরি অন্য এক মাত্রা। আজ থেকে দশ বারো বছর আগেও রেডিও বাংলাদেশ রংপুর কেন্দ্র থেকে বিকেল সাড়ে চারটায় ভাওয়াইয়া গানের যে অনুষ্ঠানটি হতো তা শোনার জন্য যে বাড়ীতে রেডিও ছিল সে বাড়ীর সবাই তো বটে বরং আশপাশের বাড়ী থেকেও নারী পুরুষ নির্বিশেষে জমা হতো রেডিও সেটের সামনে ভাওয়াইয়া গান শোনার জন্য। অথচ এই ক'বছরের মধ্যেই দৃশ্যপট পুরোপুরি পাল্টে গেছে। আজ আর গ্রামের লোকেরাও খুব একটা খবর রাখেনা- ভাওয়াইয়া গানের অনুষ্ঠান কখন হয়? ভাওয়াইয়া সংস্কৃতির এই পট পরিবর্তনে ইদানীং আমার মধ্যে এক ধরনের শংকা কাজ করে, তবে কী মানুষের অনুভুতি, আবেগ দিন দিন ভোতা হয়ে যাচ্ছে? নাকি এখন যে গানগুলো লেখা হচ্ছে, সুর করা হচ্ছে সেগুলোই আবেগহীন, আবেদনহীন ফলে মানুষের প্রান ছুয়ে যাচ্ছে না। আমি গবেষক নই তাই নিশ্চিত বলতে পারছি না হাজার বছরের লালিত আমাদের এই নিজস্ব গৌরবময় সংস্কৃতি কেন আজ হারাতে বসেছে। তবে এটি বলতে পারি অর্ধমৃত এই সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে গবেষনার পাশাপাশি সকল শ্রেনীর মানুষের পৃষ্টপোষকতা আজ একান্ত প্রয়োজন। নাহলে ট্রাক, বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে উত্তরাঞ্চলের আর এক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গরুরগাড়ী যেমন কালের গহ্বরে হারিয়ে গেছে তেমনি হারিয়ে যাবে প্রানের গান ভাওয়াইয়া। হয়তোবা একিদন পৃথিবীর কোন মিউজিয়ামেই এদের অস্তিত্ত্ব খুজে পাওয়া যাবে না।

Saturday, November 04, 2006

কী সর্বনাশের কথা, "বড়ই আনন্দে আছি!"

চারিদিকের ভাবসাব মতিগতি দেখে মনে হচ্ছে, রোম পুড়ছে আর নিরো বাশি বাজাচ্ছে। বাজাবেই তো রোম পুরে গেলে নিরোর তো কিছু এসে যায় না যাদের এসে যায় দুর্ভাগ্য হলো আগুন নেভনোর তাদের কোন ক্ষমতাই নেই।
বলছিলাম আমাদের মত আম জনতার কথা। আজ গ্রামের বাড়ী থেকে আসা আমার এক প্রতিবেশিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, "ভাই, দেশের হালচালটা বলেন তো একটু শুনি।" উত্তরটা শুনে কেমন যেন নিজেকেই অচেনা লাগলো। তিনি বললেন, ক্যান দ্যাশে আবার কী হইছে? বড়ই সত্য কথা। আসলেও তো দেশের কিচ্ছু হয়নি। সব আগের মতোই আছে। গাড়ী ঘোড়া যা চলার চলছে, যে যাকে যতটুকু ঠকাতে পারে ঠকাচ্ছে, যে যতটুকু শোষণ করতে পারে করছে, নৈতিকতার বাছ-বিচার না করে যে যেভাবে পারে চুরি চামারী করেই যাচ্ছে, হুদাহুদি কিছু মাথাওয়ালা মানুষ, আর রাজনৈতিক দলের নেতারা দেশ গেল, দেশ গেল বলে বৃথা কান্নাকাটি করছে।
কী রাষ্ট্রীয়, কী সামাজিক, কী ব্যক্তিগত প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই চুড়ান্ত অনিয়ম, চুড়ান্ত অবক্ষয় অথচ কত অবলীলায় দেশ চলছে। খুব বড় কোন ক্ষতি হচ্ছে না কারোরই। এইসব অনিয়ম, নৈতিকতার এই চুড়ান্ত অবক্ষয় এ থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় তাহলে কী? নাকি এভাবেই চলবে? রাষ্ট্রের দায়িত্ব যারা কাধে নেন তারা কী কখনো বিষয়টি ভেবেছেন? মনে হয় না। বিশেষত নৈতিকতার অবক্ষয় থেকে আমাদেরকে মুক্ত করবেন কে?
গতকাল এবং আজকের প্রথম আলোর দুটো খবরের দিকে তাকান। কী নির্মম নৈতিকতার অবক্ষয় এ জাতির হয়েছে বুঝতে পারবেন। গতকাল চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের রানওয়ের ১০০০গজ বৈদ্যুতিক তার কারা যেন চুরি করে নিয়ে গেছে, আর আজকের কাগজে এসেছে গতকাল মধ্যরাতে কিছু দুবৃত্ত কারমাইকেল কলেজের ছাত্রীদের হোষ্টেলে দেয়াল টপকে ভতরে ঢোকার সময় ছাত্রীদের হাতে একজন দুর্বৃত্ত ধরা পড়েছে । দুটো ঘটনার মধ্যে অনেকগুলো সাদৃশ্যের মধ্যে চোখে পড়ার মতো সাদৃশ্য হলো নৈতিকতার অবক্ষয়। নিতান্ত হিতাহিত জ্ঞানশুন্য দুদল মানুষ ঘটনা দুটো ঘটিয়েছে। আমার একটি অপকর্ম দ্বারা একজন মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে নাকি অনেকগুলো মানূষ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এই বোধটুকু মানুষ কখন হারিয়ে ফেলে। উত্তর সহজ, একমাত্র নৈতিকতার অবক্ষয় হলেই মানুষ সহজ এই বোধটুকু হারিয়ে ফেলে। সামাজিক বা ধর্মীয় শিক্ষা যখন মানুষকে ন্যায় অন্যায়ের পার্থক্য শেখাতে ব্যর্থ হয় নৈতিকতার অবক্ষয় হয় তখনই।
চুড়ান্ত বাস্তবতা হলো আমরা এই সহজাত শিক্ষা থেকে কিছুই শিখছি না। আমাদেরকে নৈতিকতা উন্নয়নের এই শিক্ষায় কারা শিক্ষিত করে তুলবেন? শিক্ষাগ্রহনের এই জীবনব্যাপী প্রক্রিয়ায় শিক্ষকের ভূমিকা পালন করে বাবা-মা, পরিবার, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষক এবং অবশ্যম্ভাবীরুপে রাজনৈতিক নেতারা। আরও মজার ব্যাপার হলো, বাবা-মা, পরিবার বা শিক্ষকগন একজন মানুষকে অন্যান্য শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারলেও নৈতিকতা শিক্ষার এই গুরুত্বপুর্ণ স্তরটিতে রাজনৈতিক নেতারাই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন কেননা নৈতিকতা শিক্ষার উল্লেখযোগ্য সময় হল যৌবন। আর এ সময়ে যুবকেরা অবশ্যই কোন না কোন রাজনৈতিক দলের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। তাহলে ব্যাপরটি দাড়ালো নৈতিকতার শিক্ষায় রাজনৈতিক দলের ভূমিকাই সবচে' বেশী। আর আমাদের এই নৈতিক অবক্ষয়ের দায়ভার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কোনভাবেই অস্বীকার করতে পারেন না। আরও জোর দিয়ে বললে বলা যায় আমাদের এই নৈতিক অবক্ষয়ে প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ দায়ী, হয় তারা আমাদেরকে শিক্ষিত করতে পারছেন না, নতুবা তাঁরা নিজেরাই নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত নন। ছোটমুখে বড় কথা বলে ফেললাম, দয়া করে মাফ করে দেবেন।
তবুও জিব্রাইলের ঘোড়ায় চড়ে দেশ নির্বিঘ্নে শা-শা করে এগিয়ে যাচ্ছে, আমরা বড়ই আনন্দে আছি, কেমন করে বলুনতো? একটা গল্প শুনুন, উত্তরটা পেয়ে যাবেন- এক নাস্তিক গোটা পৃথিবী ঘুরে ক্লান্ত হয়ে বাংলাদেশে এসে কিছুদিন থাকলেন এবং সবাইকে চমকে দিয়ে মুসলমান হয়ে গেলেন। লোকজন বলাবলি শুরু করলো, কী আশ্চর্য! লোকটি গোটা পৃথিবী ঘুরলেন কিন্তু কোথাও কোন ধর্ম গ্রহন করলেন না আর এদেশে এসে মুসলমান হয়ে গেলেন! এদের মধ্যে অতি উত্সাহী একজন তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা ভাই, আপনি হঠাত্ মুসলমান হলেন কেন বলুনতো? তিনি বললেন, "ভাই আমি পৃথিবীর যতগুলো দেশে ঘুরেছি প্রতিটি দেশেই আইন কানুন রয়েছে তা দিয়ে দেশ চলে আর এদেশে আইন কানুন কিছুই নেই অথচ দিব্যি দেশ চলছে। আল্লাহ ছাড়া কে চালাচ্ছে বলুন? তাই মুসলমান হয়ে গেলাম।"

Thursday, November 02, 2006

প্রধানমন্ত্রীর বচন ও স্বার্থহীন সম্পর্ক

সম্পর্ক শব্দটির সৃষ্টিই সম্ভবত জন্মের সাথে সম্পৃক্ত। প্রতিটি প্রাণীই স্বভাবসিদ্ধ কারণে জন্মের সাথে সাথেই জড়িয়ে পড়ে সম্পর্কের বেড়াজাল কিংবা মায়াজালে। জাল যাই হোক না কেন তবে এর সুতো যে অনেক মজবুত ভালোবাসার সম্পর্কই তার সবচে বড় প্রমান। আর সম্পর্ক শব্দটির সাথে নি:স্বার্থ শব্দটি জুড়ে দিয়ে আমরা এই শব্দটির প্রতি ভয়ংকর রকমের মিথ্যাচার করি।
সম্পর্ক কী তাহলে স্বার্থসংশ্লিষ্ট ? সুধীজনেরা নি:স্বার্থ সম্পর্ক, নি:স্বার্থ ভালোবাসার পক্ষে যতই সাফাই গাক না কেন আমি নিশ্চিতরুপে বিশ্বাস করি প্রতিটি সম্পর্কই অবশ্যম্ভাবীরুপে স্বার্থসংশ্লিষ্ট। অন্তত পরিসংখ্যান তো তাই বলে। আপনি নিজেই যদি কারও সাথে যে কোন সম্পর্কে জড়িয়ে যান সাদা চোখে দেখা এই নি:স্বার্থ সম্পর্কটিকে একবার গভীর অন্ত:দৃষ্টি দিয়ে দেখুন তো। দেখতে পাচ্ছেন কী, আপনার সম্পর্কটিও ভীষনভাবে স্বার্থসংশ্লিষ্ট। অথচ কতটা চাতুরতার সাথে সুক্ষ স্বার্থসংশ্লিষ্ট এই সম্পর্কটিকে নি:স্বার্থ বলে কলুষিত করছি।
মানূষের মতো শ্রেষ্ট জীবের হিসাব বাদ দিয়ে যদি অন্যান্য প্রাণীদের দিকে তাকানো যায়, ফলাফল আসবে মানূষের মতই। খাদ্য, প্রজনন, বেচে থাকা সহ মৌলিক অন্যান্য কারনের প্রেক্ষিতেই এদের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কোন কোন ক্ষেত্রে স্বার্থসংশ্লিষ্ট এ সম্পর্ক আজীবন টিকে থাকে আবার কোন ক্ষেত্রে টিকে থাকে একটি প্রজনন কাল পর্যন্ত।
আমাদের দেশের একজন প্রধানমন্ত্রী "পাগল ও শিশু" ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নয় বলে সাময়িকভাবে সমালোচিত হয়েছিলেন। কিন্তু এখন যেমন প্রমানিত হচ্ছে আসলেই পাগল ও শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নয়। আমি জানি আমার এ লেখাটি পড়ে আপনিও দ্বিধায় পড়ে যাবেন আসলেও কী প্রতিটি সম্পর্কই স্বার্থসংশ্লিষ্ট ? আমি এও জানি একদিন আপনিই বলবেন আসলেই কোন সম্পর্ক স্বার্থের উর্দ্ধে নয় ।।