ওর ডাক নাম রুমন। ভালো নাম রাশেদুর রহমান।
১৯৯৮ সাল। আমি প্রভাষনা করছিলাম উত্তর বাংলা কলেজে। ব্যাংকার্স রিক্রুটমেন্টে পরীক্ষা দিয়ে এ্যপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে পেলাম ২১ সেপ্টেম্বর । যাবতীয় কাজ সেরে ব্যাংকে যোগদানের জন্য ২৩ সেপ্টেম্বর রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। মনে নানান রকম দ্বিধা, ভয় কাজ করছিলো। নতুন চাকুরী, নতুন নির্বাহী, নতুন অফিস ইত্যকার যাবতীয় ভীতি ক্রমশ: বাড়ছিলো। ব্যাংকের নির্বাহী সম্পর্কে একটি প্রচলিত ভীতি মনের মধ্যে আগে খেকেই ছিল যে, ব্যাংকের নির্বাহীবৃন্দ অত্যন্ত কঠিন হৃদয়ের মানুষ (যদিও পরে সেই ভীতি অনেকটাই কেটে গেছে এবং এখন মনে হয় ব্যাংকের নির্বাহীবৃন্দ আমার সবচাইতে কাছের অভিভাবক-শুভাকাঙ্খী)। মনে শংকার সমুদ্র নিয়েই রাতে রাজশাহী পৌছলাম। রাজশাহী আমার পরিচিত জায়গা। পড়াশূনার সুবাদে দীর্ঘ সাতটি বছর কাটিয়েছি ওখানে। ওখানকার জল, হাওয়া আমার অতি পরিচিত। কিন্তু তবুও নতুন পরিচয় নিয়ে শহরে ঢুকতেই নিজেকে কেমন যেন অচেনা লাগছিল। অস্থিরতায় রাতে তেমন ঘুমাতে পারলাম না। সকালে ঘুম থেকে উঠে কোনরকম নাস্তা সেরে বিভাগীয় অফিসের দিকে রওনা দিলাম।
লক্ষীপুর মোড় বামে রেখে ডানদিকে জীবন বীমা ভবনের দিকে তাকাতেই বুকটা ধ্বক করে উঠলো। জনতা ব্যাংকের বিভাগীয় কার্যালয় তখন ওটিই। আর রাজশাহী শহরের সবচেয়ে উচু ভবনও ছিল ওটি। সন্ত্রস্ত পায়ে ক’তলায় উঠেছি মনে নেই তবে ভুল করে হলেও বিভাগীয় অফিসে পৌছে যাই যথা সময়ে। সব অপরিচিত মুখের মধ্যে আমার চোখ সম্ভবত একজন মানুষকে খুজছিল-যাকে ভরসা করা যায়। না তেমন কেউই নেই। কী করবো, কাকে জিজ্ঞাসা করবো ভাবতে ভাবতে ব্যালকনিতে পায়চারী করছিলাম।
‘ভাই, আপনি কী জয়েন করতে এসছেন?’ এমন প্রশ্নে সচকিত হয়ে তাকিয়ে দেখি একজন সুদর্শন যুবক আমাকেই প্রশ্নটি করছে। কম্পিত গলায় উত্তর দিলাম ‘জ্বী ভাই’। আবারো সেই যুবকের প্রশ্ন ‘তো বারান্দায় দাড়িয়ে আছেন কেন? আসুন আমিও জয়েন করতে এসেছি। আমার কাজ হয়ে গেছে। আমি আপনাকে সাহায্য করছি।’ সেই যুবক আমার চাকুরীতে যোগদানের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতার পুরোটাই একহাতে করে দিল। আমি অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করলাম একজন সম্পুর্ন অপরিচিত মানুষ কেমন করে অতিপরিচিত আপনজন হয়ে ওঠে। ১৯৯৮ সালে আপনজন হয়ে ওঠা ওই যুবকটিই রাশেদ। রাশেদুর রহমান রুমন।
এর পর ১৯৯৯ সাল। এরই মধ্যে আমি জেনেছি রাশেদ কালীগঞ্জের ছেলে। কর্মসুত্রে আমিও থাকি কালীগঞ্জে, সে সুত্রে পরিচিতির পরিধিটা আরও অনেকটা বেড়ে ওঠে। ‘ভাই’ ছেড়ে রাশেদ আমাকে ‘রবি দা’ ডাকা শুরু করেছে। ও তখন লালমনিরহাট প্রধান শাখায় কর্মরত আর আমি বুড়িমারী শাখায়। অফিসার্স বেসিক ট্রেনিং কোর্সের জন্য ঢাকায় গেলাম সেটা নিরানব্বই এর মাঝামাঝি। হোস্টেলে গিয়ে দেখি রাশেদ গেটে দাড়িয়ে। বললো ‘রবি দা, আপনার জন্য রুম বরাদ্দ করা হয়েছে।’ আমি তো হতভম্ব। তখন ল্যান্ডফোন ছিল না, না ছিলো সেল ফোন, তার পরও সে হদয়ের টানেই আমার জন্য রুম বরাদ্দ করেছে।
রুমমেট হয়ে দীর্ঘ আড়াই মাস কাকরাইলে থাকা। প্রতিদিন সকালে দল বেধে ৪৮, মতিঝিলে যাওয়া। বিকেলে তন্দুুর রুটি আর শিক কাবাব খাওয়া। সাবিনার সাথে ওর ভাললাগা (ভালবাসা নয়, কেননা ভালবাসার জন্য যথেষ্ট সময় ছিল না তখন)। পরে সাবিনার সাথে বিয়ে। দুই কন্যার জনক হওয়া। চাকুরী, ব্যাক্তিগত জীবন নিয়ে সাবলীল জীবন যাপন। ১আগষ্ট ২০১৬ এর মধ্যহ্ন পর্যন্ত সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল। স্বাভাবিক ছিল। মধ্যাহ্নের পর সব কিছুই কেমন পাল্টে গেল। কতগুলো স্বপ্ন এলামেলো হয়ে গ্যালো। এক আগষ্ট ঘড়ির কাটা থেমে গ্যালো, একটি স্বত্তায়, একটি জীবনে।
জনিনা, আমার জীবনের পথচলা আর কতটা বাকি আছে। তবুও যতটুকু আছে তাতে কী কেউ রাশেদের মতো আগবাড়িয়ে আমাকে বলবে, ‘ভাই, আপনি কী জয়েন করতে এসছেন? অথবা ‘রবি দা, আপনার জন্য রুম বরাদ্দ করা হয়েছে।’
আজ বিশ আগষ্ট ২০১৬। ম্যানেজারস ফোরামের ব্যবস্থাপনায় রাশদের শোকসভা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় অফিসে। এই ২০ দিনেই পলে পলে অনুভব করছি, বেঁচে থাকা প্রতিটি মানুষের জন্যই এরকম একজন রাশেদের খুব বড় বেশী প্রয়োজন আজ।